118Views 0Comments
কলেজ লাইফে তখন হোস্টেলে বন্ধুদের সাথে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এমনই এক শীতল, স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় আমাদের মেট্রিক পরীক্ষার বৃত্তির রেজাল্ট দিল। সব বন্ধুবান্ধব বৃত্তি পাইলেও আমি পাই নাই। জীবনে এই বৃত্তির কোন মর্ম নাই এখন বুঝলেও সেই রাতে হোস্টলের বাইরে গিয়ে একটা মাঠে বসে কাঁদতে কাঁদতে মনে হয়েছিল বেঁচে থেকে আর কি লাভ?
ইন্টার কিভাবে পাস করছি তা আজো জানি না। বাসার কড়া শাসন থেকে হোস্টেলে গেছি। একদম স্বাধীন। বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, মাস্তি, হ্যাংআউট, প্রেম। মনে হতো স্বর্গ বুঝি একেই বলে। সেই স্বর্গ আর বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই। ইন্টার কোনরকমে পাস করে গেলেও এডমিশন টেস্ট আমার জীবনে বিভীষিকা হয়ে আসে। মাঝখানে এই সময়ে আব্বু-আম্মু আমেরিকায় পাড়ি জমান। ঢাকায় ফুপুর বাসায় থেকে উদ্ভাসে ইঞ্জিনিয়ারিং এডমিশন কোচিং। খুব ভালো কিছু করতে না পারলেও মুটামুটি কোন জায়গায় চান্স হয়ে যাবে এরকম বিশ্বাস ছিল। কিন্তু বিধিবাম। সাত জায়গায় এডমিশন টেস্ট দিয়েও কোথাও টিকি নাই।
বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, ঢাবি, এমআইস্টি, আইইউবি, সাস্ট। উদ্ভাসে কোচিং, মেট্রিক-ইন্টারে গোল্ডেন এ+; বুয়েটের পরীক্ষা দিয়ে আসার পর আব্বু ফোন করে প্রথমেই বললেন- ” কয় কেজি মিস্টি অর্ডার দিব”? সে সময় আমার অনুভূতি কীরকম হয়েছিল তা মনে হলে আজো কান্না চলে আসে। ছাত্র হিসেবে মুটামুটি খারাপ ছিলাম না। তাই এই সুযোগে বংশের ও পরিবারের অনেকে নেতিবাচক কথার তীরে আমার বুক বিদ্ধ করে ফেলে।
“ছেলেকে এতদূর পড়িয়ে কি করলে”- আম্মুকে এমন কথাও শুনতে হইছে। সাতটা ভার্সিটিতে যখন চান্স হয় নাই তখন আহসানউল্লাহ’য় ইঞ্জিনিয়ারিং কোন সাবজেক্টে ভর্তি হব বলে ঢাকা থেকে কোনরকমে পালিয়ে বাসায় আসলাম। আমার ভাই-বোনদের দেখার জন্য আম্মুও তখন আবার দেশে। দুই ভাইকে নিয়ে আম্মু ঘুমাতেন। অনেক রাতে ঘুমের মধ্যে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলে আম্মু শান্ত করতেন। মসজিদে গেলেই সবাই পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস করতেন। বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলতে বের হইতাম, সবার এই প্ল্যান সেই প্ল্যান শুনে বাসায় এসে দরজা বন্ধ করে পাগলের মত কাঁদতাম। সেই বিভীষিকাময় দিনের পর এখনো কীভাবে নি:স্বাস নিচ্ছি তা আমার কাছেই বিস্ময়। ইঞ্জিনিয়ারিং এ আমার কোনকালেই আগ্রহ ছিল না।
তাই বাসায় ভুলভাল বুঝিয়ে আহসানউল্লাহ’য় আর ভর্তির চেষ্টা না করে সেকেন্ড টাইম এডমিশন টেস্টের তিন মাস ওয়েস্ট করে একদিনের নোটিশে সিলেট চলে আসি। কোন প্ল্যান নাই, ঠিকমত থাকার জায়গা নাই, কী করব কিছুই জানি না। কিছুদিন একা ঘুরতে ঘুরতে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই। ইন্টারের সেই স্বর্গের মত জীবন থেকে জীবন একদম নরকের মত হয়ে যাওয়ার পর সাস্টে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগে ভর্তি হই। ইঞ্জিনিয়ারিং কোন সাবজেক্টে পড়া লাগে নাই এতেই আমি খুশি। সবকিছু যখন ঠিকঠাক চলছিল তখনই এক বছর পরে আমেরিকান এম্বেসীতে ভিসার জন্য ডাক পড়ে। খুশি হওয়ার বদলে দুশ্চিন্তায় একদম ভেঙ্গে পড়ি। কারণ আমেরিকায় এসে আবার নতুন করে শুরু করার মত এনার্জি ছিল না।
তাই পড়াশোনাটা আর করা হবে না মুটামুটি ধরেই নিয়েছিলাম। এক বছর পরে সংগ্রাম করে আবার পড়াশনা শুরু করলেও প্রথম সেমিস্টারে রেজাল্ট পাই জিপিএ ২.৬১। প্রথমদিকে বুঝতে না পারায় সব কঠিন সাবজেক্ট একসাথে নিয়ে কোনরকমে ফেইল করা থেকে বেঁচে যাই। তখন নিজেই নিজের উপর হেঁসেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল আমার জন্মই হয়েছে ব্যর্থ হওয়ার জন্য। হতাশায়, বিষণ্ণতায় কত রাতে মনে হয়েছে মারা যাই। তাও মনের জোরে মনে হত আরেকবার চেষ্টা করি। ২.৬১ থেকে ৩.০৭, ৩.০৭ থেকে টানা পাঁচবার ডিন’স এওয়ার্ড পেয়ে ব্যাচেলর শেষ করি। মাঝখানে কীভাবে কীভাবে দুইটা বইও লিখে ফেলি। এ দুইটা বই লিখতে গিয়ে যে আনন্দ পেয়েছি আর অভিজ্ঞতা হয়েছে তা এই কষ্টের কাছে কিছুই না। সেই যে বলেছিলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং এ আগ্রহ ছিল না কোনকালেই। সবসময় মনে হত এই কষ্ট, ব্যর্থতার শেষ কোথায় দেখি। ব্যাচলরের পর চির অধরা মেডিসিনে পড়ার সুযোগ হয়।
কিন্তু টিউশনে এত টাকা তা নিয়ে ভালোই চিন্তায় ছিলাম। সেই চিন্তাও কমে যায় বাংলাদেশি টাকায় প্রায় অর্ধ কোটি টাকার স্কলারশিপ পাওয়ার পর। জীবন সুন্দর। আসলে কতটা সুন্দর। দুয়েক দিন আগে আব্বুর পায়ে ঘা দেখে বললাম এমোক্সিসিলিন-ক্লাভুনালেট এন্টাবায়োটিক খাও। নিজেকে খুব বিশাল কেউ মনে হচ্ছিল। এতদিনের ব্যর্থতা, পরিশ্রমের পর একটু সূর্যের দেখা। অনেকবারই হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। কতবারই মনে হয়েছে মারা যাই। মাঝেমধ্যে এত বেশি কষ্ট হত অনেক রাত সারা রাত কেঁদে কেঁদেই কেটেছে। যতবারই ব্যর্থ হয়েছি দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছি, তারচেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে ফেরার চেষ্টা করেছি। চলার পথে হয়ত তারচেয়ে খারাপ সময় আসবে কিন্তু এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে একটাই শিক্ষা হয়েছে- জীবন থেকে কোনভাবেই স্পার্ক আর হাসি হারানো যাবে না।
“Dude, if you fear the future so much, how can you live? And how can you focus on today? I’ve got strange friends, Man. One of them is living in fear, and the other one is not living at all!” – Rancho.